আজ সাত দিন হল তিতিরের অসুখ হয়েছে। ডাক্তার কল দেওয়া হয়েছিল। তিনি এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মাথা নেড়ে চলে গিয়েছেন। অসুখটা আসলে ঠিক কি, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।
বাবা প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে ডাক্তার?
ধরতে পারছিনা ঠিক। এ এক ধরনের মানসিক অবসাদ।
ওর স্কুল কামাই হয়ে যাচ্ছে। আমি অফিস নিয়ে ব্যস্ত। খুব মুশকিলে পড়ে গেছি।
অসুখটা মানসিক। মনে হচ্ছে, ও খুব লোনলি ফিল করে।
হতে পারে। আমার ওয়াইফ মারা গিয়েছেন এক বছর আগে। তারপর থেকে ও কখনো সুস্থ নয়।
ওকে অবজারভেশনে রাখুন।
দিন তিনেক বাদে এসে আমি দেখে যাবো।
তিনি প্রেসক্রিপশন লিখে কয়েকটি ওষুধ খাওয়াবার পরামর্শ দিলেন।
আসি, মিস্টার মুখার্জী।
তিতির বিছানায় শুয়ে থাকে। মাকে খুব মনে পড়ে। মায়ের কোলের কাছে শুয়ে থাকলে, মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। রাজকন্যা রাজপুত্তুরের গল্প শোনাতেন। বাবা কাজের মানুষ। দূরের মানুষ। সর্বক্ষণ অফিস নিয়ে ব্যস্ত।
তিতিরের অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছিল। জেগে ঘুমিয়ে সর্বক্ষণ ও নানা রকম স্বপ্ন দ্যাখে। পাহাড় সমুদ্র গাছপালা নদীবন্দর পার হয়ে যায়। ভূগোল বইয়ে পড়া এস্কিমোদের দেশে হেঁটে বেড়ায়। কল্পনায় স্লেজ গাড়িতে চড়ে।
ওর খুব ইচ্ছে করে, একটা অলৌকিক জলযানে চড়ে দূর সমুদ্রে পাড়ি দিতে। দূরে দূরে অনেক অজানা দ্বীপ। দ্বীপের মধ্যে সবুজ গাছপালা। গাছে গাছে রংবেরঙের পাখি। ধীরে বয়ে যাওয়া বাতাস। চারদিকে নীল সমুদ্র। মাথার উপরে নীল আকাশ। খোলা জানালা দিয়ে ও রাতের আকাশ দ্যাখে।
মেঘেদের আড়ালে দ্যাখে, মায়ের মুখ। ও মাকে তখন বলে, মা, তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছো? আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে কেন?
ওর দুচোখে তখন বর্ষা নামে। তিতির এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নের মধ্যে দ্যাখে, এক অপরূপা রাজকন্যা ওর শিয়রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
রাজকন্যা ওর মাথায় হাত রাখে।
অবাক তিতির প্রশ্ন করে, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো?
আমি গল্প বলা রাজকন্যে। তুমি তো খুব একা। তোমাকে গল্প শোনাবো বলে এসেছি।
আমার মা কি তোমাকে পাঠিয়েছেন?
না।
তবে কেন এলে?
আমি গল্প শোনাতে ভালবাসি। পৃথিবীতে যত দুঃখী মানুষ আছে, যাদের অনেক কষ্ট, আমি গল্প শুনিয়ে তাদের মন ভালো করে দিই।
ওগো রাজকন্যে! তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কোথায় থাকো?
তোমাদের পৃথিবীতেই থাকি। আমি তোমাদের মতনই একজন। আমি পৃথিবীর, অথচ, সত্যি বলতে কি, আমি পৃথিবীর কেউ নই।
তোমার কাজটা কী?
মানুষকে গল্প শোনানো। যারা মন কষ্টে ভোগেন, তারা আমার গল্প শুনে নতুন করে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পান।
তাহলে তোমার মনে কোন কষ্ট নেই, বলো?
কে বলেছে? কষ্ট ছাড়া মানুষ হয় নাকি! তবে কি জানো, আমার কষ্টগুলো, আমার অন্ধকার দিনগুলোর মধ্যে থাকলেও, আমি সবসময় বেঁচে থাকার সুখ নিয়ে আছি। সাধারণ দুঃখ-কষ্ট আমাকে কখনো ছোঁয় না।
কার কাছে গল্প বলা শিখলে?
ছোটবেলায় সেজ জেঠিমার কাছে, আর আমার বাবার কাছে।
বাবার কথা বলবে?
উনি একজন ঈশ্বর পুরুষ। কিভাবে যে গল্পের জাল বুনে দিতেন, ছোটবেলায়।
উনি একজন স্বপ্নের যাদুকর, বলো?
বড় শান্ত স্বভাবের, বড় প্রসারিত মন।
ওই বড় মনটা ওনার কাছ থেকে তুমি পেয়েছো,
তাই কি?
হবে বোধ হয়।
এত যে গল্প বলো, তোমার কখনো কষ্ট হয়না? ক্লান্তি লাগেনা?
গল্প শোনাতে পারলে, আমার বড় আনন্দ হয়, তিতির!
তোমার মতো এত পবিত্র মনের মানুষ আমি পৃথিবীর কোথাও দেখিনি।
এবার তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। তোমার কোন অসুখ থাকবে না। গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে তোমাকে আমি সুস্থ করে দেবো।
আরে বাবা, কি ভালো! কি ভালো!
রাজকন্যা বললেন,আমার একটা ময়ূরপঙ্খী বিশাল নৌকো আছে। তুমি চাইলে, সেই নৌকায় চড়ে আমরা মোহনা ছাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যেতে পারি।
তাই বুঝি!আমাকে বরফের দেশ দেখাবে?
দেখাবো।
আর?
তোমার মনের চোখ খুলে দেবো।
কেন?
তাহলে তুমি মনের চোখ দিয়ে পৃথিবীর অনেক রহস্য জানতে পারবে।
ওগো রাজকন্যে! তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?
কক্ষনো না। তুমি কখনো রাতে নারকেল গাছের পাতার উপর জ্যোৎসনার বৃষ্টি দেখেছো?
না।
কাঠবাদাম গাছের মাথায় সোনালী ঈগল দেখেছো?
না।
বাঁশ বনে মর্মর ধ্বনির মধ্যে ক্লান্ত কোকিলের গান শুনেছো?
না।
বর্ষার দিনে মোরগ ফুলের গাছের মাথায় টিয়া পাখিদের জটলা দেখেছো?
না।
আমার কাছে গল্প শুনলে, তোমার সব না গুলো হ্যাঁ হয়ে যাবে।
তুমি আবার আমার কাছে কবে আসবে?
প্রতি মঙ্গলবার। রাত সাড়ে আটটায়।
আমার মনে হচ্ছে, আমি ভালো হয়ে যাচ্ছি। আমার কোন অসুখ নেই।
আমি এখন আসি। তুমি ভালো হয়ে যাও।
আমি আগামীকাল থেকে স্কুল যেতে পারবো।
গল্প বলা রাজকন্যে কাল রাতে এসেছিল। কী সুন্দর, কী পবিত্র তাঁর মুখ। যে সুস্থ চিন্তা, সুন্দর মন, মানুষকে উপহার দেয়, সে যে সে মানুষ নয়।
স্বার্থ শূন্য এমন ভালোবাসার মানুষ পৃথিবীতে ঈশ্বরের আশীর্বাদে আসে।
তিতির মনে মনে বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি। আমি একা নই। গল্প বলা রাজকন্যাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি।
ছুটে গিয়ে বাবার অফিস ঘরে গিয়ে তিতির বলল,
বাবা, আজ থেকে আমি স্কুলে যাবো। আমার কোন অসুখ নেই। আমি ভালো হয়ে গেছি।
বাবা আশ্চর্য হয়ে তিতিরের মুখের দিকে চাইলেন।
প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার? কি হলো?
তিতির বলল, বাবা, কাল রাতে সে এসেছিল।
কে?
গল্প বলা রাজকন্যে।
তাই নাকি!
সে বলে গেল, কেমন করে বেঁচে থাকতে হয়!
আমার কোন অসুখ নেই বাবা। আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি।