রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের সংবিধান প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করাকে নাগরিক অধিকার বলা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে নাগরিক অধিকার সম্পর্কে আমাদের জনগণ কতটুকু জানেন ? আর এই না জানার কারণেই বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জাতিসংঘের মতে উন্নয়নশীল দেশের ৮০℅ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করার কারণে শিশুরা সুবিধা বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠে। এছাড়াও যুদ্ধবিগ্রহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, দূর্ঘটনা ও বিবাহ বিচ্ছেদ জনিত কারণে শিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে শিশু পাচ্ছেনা তার নূন্যতম অধিকার।
অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমাকে মৌলিক অধিকারের কথা বলতে হয়। আমরা সংবিধানে উল্লেখিত অন্ন, বস্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা দিয়ে শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটানোর মতো উপযোগী পরিবেশ করে দিতে পারছি কিনা? যে পরিবেশে শিশু নিজেকে স্বাধীন ও মুক্তভাবে সুষ্ঠু সুন্দর মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে, এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমরা পাহাড়ি পল্লী, গ্রামের অসহায় ঘরে কিংবা শহরের বস্তিতে দেখতে পাই অজস্র শিশু নোংরা আবর্জনায় পড়ে আছে, নুন্যতম আহার পাচ্ছে না। আর এই পরিবেশেই সে বেড়ে উঠছে। পাশাপাশি সরকারি কোন বিদ্যালয়ে এদের ভর্তি করা হলেও মূর্খ মাতা-পিতা আর শিক্ষকদের নিরব ভুমিকায় ৯০% শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাই এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার, প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোকে শিশু কেয়ারহোম পদ্ধতিতে পরিচালনা করা গেলে বস্তির কোন শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে সে যেন কোন সমস্যা অনুভব না করে, এতে করে তার বস্তিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবে না। শিক্ষকগণ তাদের পাশে থেকে একাডেমি শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক, নৈতিক শিক্ষা, খেলাধুলা ও আনন্দ বিনোদন দিয়ে মানুষ করে তুলবেন। এভাবে রাষ্ট্রীয় সমতার ভিত্তিতে সকল ছাত্র-ছাত্রী একই নিয়মে বেড়ে উঠবে। তাদের মধ্যে ধনী গরীব পার্থক্য থাকবে না, সকল শিশু বুঝবে আমরা মানুষ আমরা বন্ধু, আমরা সমান।
পিতা-মাতা ও অভিভাবকহীন শিশুর জন্য আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে এতিমখানা এবং লিল্লাহবোডিং। যদিও এখানে সে থাকার স্থান পেয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে। এতিম শিশুদের চেয়েও অমানবিক জীবন অতিবাহিত করছেন প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক ও তার পরিবার। নিজস্ব আত্নীয়রা পর্যন্ত পারিবারিক ভাবে এদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না, বুঝতে চায়না এরাও মানুষ, আপনাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহ এদের সৃষ্টি করেছেন।
জাতিসংঘের হিসেবে এমন প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু আমাদের দেশে রয়েছে। সুবিধা বঞ্চিত এবং অসহায় প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্র এবং আমাদের করণীয় রয়েছে। প্রতিটি শপিংমলে র্যাম্প ও হুইলচেয়ার রাখতে হবে, থাকতে হবে এদের বিনোদনের ব্যবস্থা। প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশে সুবিধা বঞ্চিতদের তালিকায় নির্মমতার শিকার হয়ে আছেন বয়স্ক পিতা-মাতা, আধুনিকতার জৌলসে এক শ্রেণীর পাষাণ পরিবার নিজেকে ব্যস্ত সাজিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা’কে দূরে সরিয়ে রাখছে। এমন বৃদ্ধ লোকের সংখ্যাও কম নয়। এরা বৃদ্ধাশ্রম, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, ফুটপাত, ভবঘুরে জেলখানায় এমনকি ভিক্ষা করেও জীবন যাপন করছেন। একবারও কি ভেবে দেখেছেন মাঘের শীত কিংবা শ্রাবণের মেঘ কিংবা চৈত্রের তাপদহনে তাদের জীবন কেমন চলছে? আপনি পাহাড় পরিমাণ সম্পদ রেখে যাবেন সন্তানের জন্য কিন্তু নিজে এসব সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষের জন্যও কিছু করে যান, মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে তারচেয়ে অধিক কিছু দিবেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। বিনামূল্যে দিতে হবে সকল শিক্ষা সামগ্রী। পরিবারকে দিতে হবে সামাজিক মর্যাদা। উচ্চশিক্ষায় দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক ২৫/৩০ জন হতদরিদ্র কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে, প্রয়োজনে শিক্ষা শেষে সে ২ বছর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের অধীনে বিনা বেতনে কাজ করবে। কিংবা ছাত্রাবস্থায় তাকে সপ্তাহে ৫/৭ ঘন্টা কাজ করে নেয়া যাবে। মেধাবী শিক্ষার্থীকে দেশের সম্পদ মনে করতে হবে, তাকে ধনী-গরিব বুঝতে দেয়া যাবে না, তাহলেই তার থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
কি হবে অধিক সম্পদ দিয়ে? করোনা কালীন সময়ে দেখেছি বহু শিল্পপতি সব সম্পদ দিয়েও জীবন বাঁচাতে পারেনি, সামনে আসেনি স্ত্রী-সন্তান কিংবা পরিবার-পরিজন! আপনি সম্পদ রেখে যাবেন তা আপনার মৃত্যুর পরে কারো ক্ষতির কারণও হতে পারে, আবার কল্যাণময়ীও হতে পারে। আসুন যার যার অবস্থান থেকে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে ভালোবাসার বন্ধনে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলি।
সমাজে সচেতন, বিত্তশালী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ কথায় নয়, কাজে দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখুন। গড়ে তুলুন সামাজিক সচেতনতা, এগিয়ে যাবেন আপনি, এগিয়ে যাবে দেশ, সমৃদ্ধশালী হবে সমাজ।
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
এম.এস.এস.(সমাজবিজ্ঞান), এম.এ.(ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি) সহকারী অধ্যাপক।