
এক মায়ের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল।তারা যখন ছোট ছিল,তখন তাদের বাবা মারা যায়।স্বামীর অল্প কিছু জমি ছিল,সেটাই চাষ করে মা অতি কষ্টে ছেলেদের লালন পালন করে। সবাইকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলে মেয়ের বিয়ে দেন। তারা সবাই
প্রতিষ্ঠিত এবং সন্তান-সন্ততির মা-বাবা হয়েছে। ছেলেরা বিয়ের পরে গ্রামের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে পৃথক হয়ে যায়। ছোট ছেলের মায়ের প্রতি একটু বেশি ভালবাসা ছিল।তাই মা ছোট ছেলের সাথে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
একদিন মা ছোট ছেলেকে বলেন,বাবা আমার একটা সোনার হার পরার খুব সখ ছিল।তোর বাবা তোদের জন্য সে সখ পূরণ করতে পারেননি। আমাকে একটা সোনার হার বানিয়ে দিবি। মাকে খুশী করার জন্য ছোট ছেলে মাকে একটা সোনার হার বানিয়ে দেয়।মাকে আদর-যত্নে রাখে। এভাবে কিছুদিন যাবার পর ছোট ছেলের বউ শাশুড়ীকে বলে, ‘মা তোমার বিষয়- সম্পত্তি ছোট ছেলেকে লিখে দাও, আমরা তোমাকে এভাবেই আমরা আমৃত্যুকাল যত্ন করব। ছেলে ও বউ এর ব্যবহারে মা প্রীত হয়ে তার যাবতীয় সম্পত্তি ছোট ছেলেকে লিখে দেন। তার ধারণা ছিল যে, তিনি বেশি দিন বেঁচেও থাকবে না।
মানুষের চরিত্র বড়ই জটিল ও দুর্বোধ্য। যাকে অতি সৎ লোক মনে করা হয়, সে-ই একদিন এমন এক অপকর্ম করে বসে, যার ফলে তার দীর্ঘদিনের সুনাম নিমেষে শেষ হয়ে যায়।
মা প্রতি রাতে সোনার হার খুলে রেখে ঘুমান। সকালে আবার পরেন। একদিন তিনি পরতে ভুলে যান। যখন মনে পড়ে, তখন আর খুঁজে পান না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মা হার না পেয়ে কান্না শুরু করে দেন। মা বলেন, ‘বউ ছাড়া এ ঘরে তো আমি আর কাউকে কখনও আসতে দেখিনি’।
শাশুড়ীর কথায় বউ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বলে, আমিই কি তাহ’লে চুরি করেছি। আমার কথায় আমার স্বামী তোমাকে হার বানিয়ে দিয়েছে। আর এখন আমি চোর হ’লাম। মা বললেন, আমি তোমাকে চোর বলিনি। তুমি ছাড়া আমি তো আর কাউকে এ ঘরে আসতে দেখিনি। তুমি নাওনি, তবে গেল কোথায়? ছেলে মা-বউ এর কথা কাটাকাটি থামাতে ব্যর্থ হ’ল। কথা কাটাকাটি চরমে উঠলে মা বললেন, তোমরা আমার বিষয়-আশয় হস্তগত করার কুমতলবে আমাকে আদর-যত্ন করেছ এবং হার বানিয়ে দিয়েছ।
আমার বিষয় সম্পত্তি ফিরিয়ে দাও আমি চলে যাব।
এই বলে মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল বড় ছেলের কাছে। বড় ছেলে বউ বলে তুমি সমস্ত সম্পত্তি ছোট ছেলেকে লিখে দিয়েছো, এখন আমরা কেন তোমাকে খাওয়াবো? তুমি যেখানে খুশি চলে যাও। এখানে তোমার জায়গা হবে না।
মা আর কি করবেন সাত পাঁচ ভেবে মেয়ের কাছে যান।মেয়ে জামাই আগেই শুনেছিল,যে মা তার সব সম্পত্তি ছোট ছেলের নামে লিখে দিয়েছে। মেয়ে জামাই ও বলল ছোট ছেলের নামে সব জমিজমা লিখে দিয়ে এখন কেন আমাদের কাছে এসেছ? আমরা তোমাকে দেখতে পারবো না। তুমি যেখানে খুশি চলে যাও।
মা কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় চলে যান মনে মনে ভাবেন, যে কটা দিন বাঁচব, ভিক্ষা করে খেয়ে রাস্তাতেই কাটিয়ে দেবো।
এভাবেই তিনি পাঁচবাড়ি ভিক্ষা করে খান আর রাত্রে একটা প্রতীক্ষালয়ে রাত কাটান।
একদিন ট্রেন থেকে এক যুবক নামলো,নেমে জিজ্ঞাসা করল কাকিমা কেমন আছেন ?আমি তন্ময়। একটা সময় আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করে খেয়ে লেখাপড়া শিখেছিলাম।এখন চাকরিসুত্রে বিদেশে থাকি।কিন্তু আপনার ছেলে মেয়ে জমি জায়গা সবকিছু থাকতেও আজ আপনার এই দুর্দশা কেন?
তিনি তন্ময়কে সব কথা খুলে বলেন। তন্ময় বলে আমার তো মা বাবা কেউ নেই, আপনি আমাকে বড়ো করেছিলেন।চলুন আজ থেকে আপনি আমার বাড়িতেই থাকবেন।মা চলে গেল পালিত পুত্রের বাড়ি।
সেখানেই খুব আদর যত্নে থাকেন।একদিন তন্ময়ের মাথায় এক বুদ্ধি আসে।বাজার থেকে একটা পিতলের কলসি কিনে তাতে খোলামকুচি দিয়ে ভর্তি করে সোনার দোকান থেকে শক্ত করে গালা দিয়ে কলসির মুখ বন্ধ করে আনে।এবং কাকিমাকে বলে কাকিমা তোমার স্বামী মারা যাওয়ার আগে,আমার কাছে এই সোনার মোহরগুলো রেখে গিয়েছিলেন।এটা আপনার ছেলে মেয়েদের খবর দিয়ে দিন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে এই মোহর আপনি কাউকেই দেবেন না।আর এই মোহরের কলসির মুখটা খুলবেন না।
ছেলে মেয়েরা খবর পেয়েই সবাই একসঙ্গে ছুটে আসে। সবাই মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়।শেষ পর্যন্ত গ্রামের মোড়লের উপস্থিতিতে বিচার হয় মা তিনজনের কাছেই এবার থেকে সমানভাবে থাকবেন। মৃত্যুর পর মোহরগুলো তিনজনে সমান ভাবে ভাগ করে নেবে।
তিন ছেলেমেয়ে এখন মাকে খুব যত্ন করে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়ায়। এরপর একদিন মায়ের মৃত্যু ঘটে। মাকে দাহ করে আসার পর সবাই সেই কলসির মুখ খুলে মোহর ভাগ করতে যায়।
কিন্তু কলসি খুলে তারা দেখলো কলসির ভেতর খোলামকুচি ছাড়া আর কিছুই নেই।তারা তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে পারলো।এবং ছোট ছেলের কাছে থাকা সম্পত্তি তিনজনে সমান ভাগে ভাগ করে নিলো।
নীতিকথা:- পিতা মাতাকে দেখাশোনার দায়িত্ব সন্তানের।
কোন লোভের বশবর্তী হয়ে নয়।