ধারণা করা হয়, শহরটি তিনি তাঁর নামানুসারে করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তাঁর প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। সম্রাট আকবর যখন বাংলায় তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করতে শুরু করেন, তখন বাংলার বারো ভূঁইয়ারা এবং মোগল বিদ্রোহীরা শেরপুরকে তাঁদের আশ্রয়স্থল হিসেবে খুঁজে পান। এই সময়ে তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের উদ্দেশে খেরুয়া মসজিদ গড়ে উঠে। মসজিদের ওপরে কুলুঙ্গতে খোদাইকৃত শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৮২ সালের ২০ জানুয়ারি জওহর আলী খান কাকশালের পুত্র মির্জা মুরাদ খান এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করতে আরো কয়েক বছর সময় লেগেছিল বলে ধারণা করা হয়।
মসজিদের নামকরণ
খেরুয়া মসজিদের নামকরণ স্পষ্ট নয়। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর ‘বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ’ বইতে উল্লেখ করেছেন—এ মসজিদের খেরুয়া নামের কোনো ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়নি। আরবি বা ফারসি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।
তবে ফারসিতে ‘খায়ের গাহ’ বলে শব্দ আছে। যার অর্থ ‘কোনো স্থানের ভেতরে’। রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার, তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। তবে মসজিদটি যদি শেরপুর দুর্গের ভেতরে নির্মিত হয়ে থাকে, তবেই ‘খায়ের গাহ’ থেকে খেরুয়া নাম হতে পারে বলে অনুমান করা যায়।
মসজিদ স্থাপত্যশৈলীর বিবরণ
মসজিদটি একটি আয়তাকার স্থাপত্য। এর দৈর্ঘ্যের পরিমাণ ১৭.৬৭ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৬২ মিটার; দেয়ালের পুরুত্ব ১.৯৫ মিটার। মসজিদটির পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশদ্বার আছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারটি অন্য প্রবেশদ্বারের তুলনায় বড় ও প্রশস্ত। প্রতিটি প্রবেশপথ একেবারে সুস্পষ্ট। মসজিদের অভ্যন্তরে পূর্ব দেয়ালের প্রবেশদ্বারের সঙ্গে মিল রেখে তিনটি মিহরাব আছে। আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে অর্ধগোলাকার মিহরাবগুলো স্থাপিত। মিহরাবের কারুকার্যগুলো মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই সুন্দর। মসজিদের চতুর্দিকে চারটি অষ্টাভুজ আকৃতির মিনার আছে, যা ছাদ পর্যন্ত উত্থিত। এগুলো মসজিদের কাঠামো আরো সুদূঢ় করেছে। এই মসজিদের কার্নিসগুলো সুলতানি আমলের স্থাপত্যের মতোই বাঁকানো। কার্নিসেও ছোট ছোট পোড়ামাটির তৈরি কারুকার্য লক্ষ করা যায়।
মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ দুটি খিলানাকৃতির দ্বার দ্বারা সমান তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। তিনটি ভাগই অর্ধগোলাকার গম্বুজ দ্বারা আবৃত। মসজিদের খিলানের স্প্র্যান্ডেলের ওপর গোলাপ দ্বারা সজ্জিত। পূর্ব দিকের দেয়ালে কুলুঙ্গিও দেখা যায়। মসজিদের ভেতরে ঢুকে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখা যাবে ইটের অতি চমৎকার নান্দনিক কারুকার্য। মসজিদের দেয়ালের গাঁথুনিও অসম্ভব নান্দনিক। মিনার, গম্বুজ, নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনিতে গোটা মসজিদ নজর কাড়ে। গাঁথুনি দেখলে মনে হবে পরম যত্নে নির্মাণকাজ করা হয়েছে। মসজিদের দেয়ালজুড়ে টেরাকোটার কাজ; ফল, লতা-পাতা দিয়ে নকশা করা। প্রায় ৫৯ শতাংশ জায়গাজুড়ে মসজিদটির অবস্থান। লাল এই স্থাপত্যের সামনেই আছে খোলা সবুজ মাঠ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মাঠে কার্পেটের মতো ঘাস শুরুতেই চোখে পড়ে। মসজিদের পাশে নারকেল, তাল, কদম ও আম গাছের সারি দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এই মনোরম দৃশ্য দেখতে এখানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের ভিড় জমে। প্রতি শুক্রবার ও ধর্মীয় বিশেষ দিনগুলোতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আসে।
খেরুয়া মসজিদ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নত্ত্ব নিদর্শন। মোগল-পূর্ব সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মোগল স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে নির্মিত এই মসজিদ। প্রায় ৪৪১ বছর ধরে টিকে আছে এই মসজিদ।
প্রাচীন মোগল যুগের স্মৃতিঘেরা এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। প্রাচীন এই মসজিদের স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে পর্যটকদের।
লেখক : প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা