স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জেনেভা ক্যাম্পে ‘বনিয়া সোহেল’ ও ‘পারমনু’ নামে দুই সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে আসে। মাদক ব্যবসার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই দুই গ্রুপে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় প্রতিদিনই তাদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটছে। এতে হতাহতের ঘটনা বেড়েই চলছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের সংঘাতে যুক্ত হয় মোহাম্মদপুর ও গণভবন থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পুলিশ এসব সন্ত্রাসীর কাছে অসহায়। পর্যাপ্ত টহল ব্যবস্থা না থাকায় এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হচ্ছে। তবে মোহাম্মদপুরে প্রতিটি হাউজিংয়ে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হচ্ছে।
সর্বশেষ গত ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনায় শিশুসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধরা হলেন- আমিন (২৭), শফিক (৩২), সাজ্জান ওরফে রহমত (৮) ও অজ্ঞাত একজন। এর আগে, ১৬ অক্টোবর জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে রেস্তোরাঁকর্মী মো. শানেমাজ (৩৮) নিহত হন। গত ৪ সেপ্টেম্বর জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে রিকশাচালক মো. সনু (৩০) নিহত হন।
নিহত সনুর প্রতিবেশী সাজিদ বলছেন, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি বনিয়া সোহেলকে ঘটনার দিন সকালে সনু বলেন, তুমি মাদক বিক্রি করছ, এতে এখানকার ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে সোহেলসহ কয়েকজন সনুর ওপর গুলি চালায়। এটি সনুর বুকে লাগলে নিহত হন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে র্যাব-২ ও যৌথবাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় দুটি পিস্তল, ২০টি গুলি, দেশি অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়। র?্যাব বলছে, গ্রেপ্তারদের মধ্যে চারজন মাদক ব্যবসায়ী । বাকিরা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। পুলিশ বলছে, সরকার পতনের পর থানা ও গণভবন থেকে লুট করা অস্ত্র জেনেভা ক্যাম্পের পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। মূলত মাদক ব্যবসার আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এসব সংঘর্ষের ঘটনা।
গতকাল আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে মোহাম্মদপুর, আদাবর এবং শেরেবাংলা নগর থানা এলাকার ১৫২ জন অপরাধী, ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৭১ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১৭২ ধরনের বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অস্ত্র, একটি গ্রেনেড এবং বিপুল পরিমাণ নেশাজাত দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। সন্ত্রাস দমন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে।
সম্প্রতি বছিলায় একটি মিনি সুপারশপে দুর্র্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতির ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন চাপাতি হাতে সুপারশপে থাকা দুজনকে জিম্মি করে কাউন্টার থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানে কয়েক শ কিশোর হাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিশাল বড় মহড়া দেয়। এ সময় তারা রাস্তায় যাকে পায় তাকেই ভয়ভীতি দেখায়।
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় এদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় একাধিক মামলা ও অভিযোগ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মোহাম্মদপুর থানা ও গণভবন থেকে এই মাদক ব্যবসায়ীরা অস্ত্র লুট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিনিয়ত চলা সংঘর্ষে এসব অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে বলে স্থানীয়রা দাবি করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে সেগুলো লুটের আগ্নেয়াস্ত্র নয় বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ।
জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ৫০ হাজার লোকের বসবাস। ঘনবসতি এই এলাকায় যেতে হয় বাবর রোড, হুমায়ুন রোড ও গজনবী রোড দিয়ে। ৯টি সেক্টরে বিভক্ত এই ক্যাম্পের ভিতরে চলাচলের জন্য রয়েছে ৩০টি সরু রাস্তা। প্রায় ৮-১০ ফিট সাইজের ঘরের একতলা, দোতলা ও তিনতলা ভবনে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন বাসিন্দারা। বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা গাড়ির চালক, মাংস বিক্রিসহ নানা কাজে সম্পৃক্ত থাকলেও অনেকের আয়ের মূল উৎস্য মাদক বাণিজ্য। মাদকের আখড়া হিসেবে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ৫ শতাধিক মাদকের স্পট রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, জেনেভা ক্যাম্পের চারপাশেই নানারকম দোকানপাট। ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্যাম্পের ভিতরে প্রচুর অলিগলি। সেগুলোতেও অনেক দোকান। সেখানে প্রচুর লোকজনের আনাগোনা। এমন ভিড়ের মধ্যেই নির্ধারিত স্পটে চলছে ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইন বেচাকেনা। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, শুধু ক্যাম্প না, ক্যাম্পের আশপাশে যত ইয়াবা সিন্ডিকেট আছে, সব এরা নিয়ন্ত্রণ করছে। ওদের অনেক ক্ষমতা, তাই কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এদের অত্যাচারে আশপাশের বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানান, জেনেভা ক্যাম্পে যারা সংঘর্ষ বা গোলাগুলিতে সরাসরি জড়িত, তারা সেখানে থাকছে না। তারা মূলত বাইরে থেকে এসে এসব সংঘাত সৃষ্টি করছে। জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে র্যাবের অভিযান ও টহল বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে জেনেভা ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব। ইতোমধ্যে জেনেভা ক্যাম্পে দুটি বড় ব্লক রেইড পরিচালনা করা হয়। এতে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে অংশ নেয়। এই অভিযানে প্রচুর অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে ক্যাম্প থেকে উদ্ধার অস্ত্র লুট করা অস্ত্র নয় বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি হাউজিংয়ে অস্থায়ী সেনাবাহিনীর ক্যাম্প বসানো হবে। শনিবার রাত ১টায় বসিলা সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপ-অধিনায়ক মেজর নাজিম আহমেদ।
তিনি এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান, আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের তথ্য দিন। তথ্য দিলে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছাবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটিতে অভিযান চালিয়ে ৪৫ জনকে আটক করে তাদের মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে জানিয়ে মেজর নাজিম আহমেদ বলেন, আটকদের মধ্যে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ জন কিশোর গ্যাংয়ের লিডার রয়েছে। তারা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক বিক্রিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। এলাকাবাসীকে শান্তিতে রাখতে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মোহাম্মদপুরে ২৭ থেকে ২৮টি কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, জেনেভা ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ছয়বার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সেখান থেকে প্রচুর দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ পর্যন্ত যত গ্রেপ্তার হয়েছে তার ৩০ শতাংশ জেনেভা ক্যাম্পের। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, এ সময় ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৬১ রাউন্ড গুলি, ১৯ রকমের মাদক, একটি গ্রেনেড, ৮০টি দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।