প্রিন্ট এর তারিখঃ এপ্রিল ১৯, ২০২৫, ৮:১৭ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ১১, ২০২৪, ৪:৪০ এ.এম
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে একটি গোরুর মালিককে দেখলাম গোরুটির দাম দেড় কোটি টাকা হাঁকাচ্ছেন। গোরুটি নাকি ওজন বা মাংসের জন্যে নয়, তার বংশমর্যাদার জন্যে এতো দামী। এটির নাকি একশো দশ বছরের পূর্ব পুরুষের বংশ খতিয়ান আছে। এটি নাকি আমেরিকান নোবল পরিবারের। আগে দেখতাম বিয়েশাদিতে পাত্র-পাত্রীর কুষ্ঠি দেখা হতো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায়, এখন দেখছি কোরবানির পশুরও কুষ্ঠি দেখা হচ্ছে!
আমি মনে করি এই গোরু মালিক এবং এটিকে যিনি কিনবেন তারও চৌদ্দ গোষ্ঠির কুষ্ঠি ও আয়ের উৎস খতিয়ে দেখা উচিত, শত হলেও কোরবানি বলে কথা!
আজ একটু ফ্ল্যাশ ব্যাকে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, গেরস্ত তার পালের ওই গোরুটিই কোরবানি দিতেন যেটি বুড়ো হয়ে গিয়েছে, হাল বাইতে পারতো না, কিংবা অলস গোরু যেটি হালে শুয়ে পড়তো, কিংবা সেই গাভী যেটি আর বাচ্চা দিতে পারতো না বা বন্ধ্যা। সেটিকে গেরস্ত বেশি করে খাইয়ে দাইয়ে তাজা করে হয় নিজে কোরবানি দিতেন নয়তো বিক্রি করে দিতেন।
এখন কী যুগ আসলো, গোরুর খামারে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করে কোরবানির হাটের জন্যে পশু প্রস্তুত রাখা হয়। বাহারি নামের এই পশুগুলো নিজের ভার নিজেই বইতে পারে না, হাঁটতে পর্যন্ত পারে না, পরিবহনে বহন করতে হয়। এদেরকে বাতাস করতে হয়, মশারীর ভেতর রাখতে হয়, মাথায় পানি ঢালতে হয়, গামছা দিয়ে ঘনঘন শরীর মোছাতে হয়, শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতে হয়। এরা অসুস্থ, এরা কাজের অনুপযোগী। এই অসুস্থ গোরুগুলির গোসত খেতে আমার রুচি হয় না। এগুলো চাষের পাঙাশ মাছ কিংবা ব্রয়লার মুরগীর মতো। এগুলো যারা কোরবানি দেয় তারাও অসুস্থ মানসিকতার। ওরা কোরবানির জন্যে নয়, নাম ফাটানোর জন্যে এসব করে। আপনাদের টাকা আছে বলে আপনি যাচ্ছে তাই ভাবে তা অপচয় করতে পারেন না। মনে রাখবেন আপনার টাকায় অনেক অভাবী লোকের হক রয়েছে, যারা কোরবানি ছাড়া সারাবছর এক টুকরো গোসত কিনে খেতে পারে না! আমি একজন লোককে চিনি যিনি আমার বাসার পাশের বাজারে মাছ কাটার কাজ করেন। লোকটি একদিন আমি অনেকগুলো মাছ কাটানোর পর নিচু স্বরে বললেন, আমাকে মজুরি দিতে হবে না, কয়েক টুকরো রুই মাছ দিয়ে যান। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, সারাদিন মাছ কাটলেও ভাববেন না, আমি প্রতি ওয়াক্তে মাছ ভাত খাই। তিন মাস হলো বাসায় কোনো বড় মাছ নিতে পারিনি। ছোটো ছেলেটি গতরাতে মাছের বায়না ধরে শাকপাতা দিয়ে ভাত না খাওয়ায় বিরক্ত হয়ে তাকে মেরেছি। রাগ করে আমিও আর রাতে ভাত খাইনি; বলেছি আজ মাছ নিয়ে যাবো। আজ কয়েক টুকরো মাছ না নিয়ে বাসায় গেলে ছেলেটিকে মুখ দেখাতে পারবো না! সারাদিন কতো মানুষের বড় বড় মাছ কাটি, ইচ্ছে করলেই ফাঁকে জোখে দু'এক টুকরো নিচে ফেলে দিতে পারি, আসেপাশের অনেকেই করে, কিন্তু আমার মনে সায় দেয় না। আবার অল্প টাকায় গুড়া গাড়া মাছ পাওয়া গেলেও বড় মাছ কেনার সামর্থ হয় না।
আমাদের সময়ে রেফ্রিজারেটর যেমন ছিলো না, তেমনি মানুষের মানসিকতাও এতোটা কঠোর ছিলো না। তারা কোরবানির মাঠেই একতৃতীয়াংশ গোসত গরীব ও সমাজের মানুষের জন্যে রেখে আসতেন, একতৃতীয়াংশ নিকটাত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি পাঠাতেন, আর বাকিটা নিজেরা খেতেন। গোসত সংরক্ষণের কোনো পদ্ধতি না থাকায় লবন হলুদ, মরিচ দিয়ে কষিয়ে চালনীতে ছড়িয়ে রাখতেন এবং ক্ষণেক্ষণে জাল দিতেন। এভাবে বড়োজোর সপ্তাহখানেক খাওয়া যেতো। শেষদিকে গোসত নরোম হতে হতে একেবারে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেতো, খেতে বেজায় মজা হতো। আজকের দিনের তথাকথিত অভিজাতদের মতো ডিপ ফ্রিজে রেখে বছর ভরে আমাদের সময়ের লোকেরা কোরবানির গোসত খেতেন না, আর গোসত নরোম করার জন্যে প্রেসার কুকারও ব্যবহার করা লাগতো না, অবশ্য তখন প্রেসার কুকার ছিলোও না! অবশ্য মা-চাচিগণ কয়েক টুকরো কষানো গোসতের টুকরা মালা গেঁথে রোদে শুকিয়ে শুটকি বানিয়ে রেখে দিতেন যা পরে গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে নরোম হলে রেঁধে খাওয়া হতো। আহা, আমাদের সময়টা কতোই না নির্মল, নির্মোহ ও উপভোগ্য ছিলো! এখন তো অনেকে ভাগাভাগিই করেন না, পশু জবেহ করার পর পরই বড় বড় পিস করে ফ্রিজে ঢুকাতে ব্যস্ত থাকেন! অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেকে আবার শুধুই বিতরণের জন্যেও কোরবানি করেন। অনেক ধনীর কলাপসিবল গেট টপকে গরীব মানুষ ভেতর পর্যন্ত যেতে পারে না। আবার অনেক টোকাই গোসত কুড়িয়ে বিক্রিও করে। সমস্যা হলো মধ্য বিত্তদের। অনেকেই শরীয়ার চেয়ে ইজ্জতের ভয়ে কোরবানি করেন। ইনারা একা দিতে পারেন না, সাত ভাগে দেন। তথাকথিত ধনীদের বিড়ম্বনার পশুর দাম যায় বেড়ে, আর মধ্যবিত্তের লোকেদের ভাগের বাজেট বেড়ে গেলে খাবি খায়। নিম্ন বিত্তের এমন অনেকেই আছেন যারা কোরবানি দিতে পারেন না, আবার চেয়েও আনতে পারেন না। এদেরকে কেউ সেধে দু' টুকরো গোসত কেউ দেয় না। এদেরকে কোরবানির কথা জিজ্ঞেস করে লজ্জিত করবেন না। জিজ্ঞেস করলে বলবে, গ্রামের বাড়িতে দিচ্ছি। এদের সম্ভ্রম বাঁচাতে মিথ্যা বলতে বাধ্য করবেন না। পারলে সম্মানের সাথে গোসত বাসায় দিয়ে আসবেন।
আমি সাধারণ আয়ের একজন মানুষ। ইচ্ছে করে অনেক গোসত বিতরণ করি, কিন্তু সেইপরিমাণ সামর্থ নেই, ভাগে কোরবানি দিই। লকডাউনের সময় একবার এমন হয়েছিলো যে আমার হাতে মোটেও টাকা ছিলো না। অনেকটা কোরবানি না দেয়ার অবস্থা। ঈদের আগেরদিন বিকেলবেলা। পাড়ার রাস্তাগুলো কোরবানির পশুতে ঠাসা। গিন্নি বাসায় এসে আমরা কোরবানি করতে পারবো না জেনে নীরবে অশ্রুপাত শুরু করলেন। সাথে যোগ দিলো আমাদের কন্যা। ওদের মনরক্ষার্থে শেষপর্যন্ত নানা কায়দাকানুন করে কোরবানির ব্যবস্থা করি।
আজ মনেমনে ভাবলাম, আচ্ছা, আমি যদি সেই দেড় কোটি টাকার বংশমর্যাদা সম্পন্ন গোরুটি কোরবানি দিতে চাইতাম! বাস্তবতা হলো, আমার সারাজীবনের সঞ্চয় এবং স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পদ এক করলেও ওই এক গোরুর দামের সমান হবে না। তারমানে হলো, আমার মূল্য একটি গোরুর চেয়েও কম!
সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!